[স্থান : এগারোসিন্ধুর পরপারে মহারাজ মানসিংহের শিবির
চরিত্র : মানসিংহ, দুর্জয়সিংহ ও দূত]
মানসিংহ : শোনা যায়, একদা এক অসুররাজ গোষ্পদে ডুবে মরেছিল। একথা বিশ্বাস করো, দুর্জয়সিংহ?
দুর্জয়সিংহ : এ পুরাণের কাহিনিমাত্র। বিশ্বাস করি না!
মানসিংহ : আমিও আগে বিশ্বাস করতাম না, দুর্জয়সিংহ, কিন্তু এখন বিশ্বাস করি ৷
দুর্জয়সিংহ : সত্যি বিশ্বাস করেন, মহারাজ?
মানসিংহ : চোখের সামনে যা ঘটে গেল, দুর্জয়সিংহ, তাতে বিশ্বাস না-করি কেমনে, তাই বলো । নইলে বাংলার এক অজ্ঞাতনামা ক্ষুদ্র পাঠানসর্দার ঈসা খাঁ, তারই তলোয়ারতলে মারা যায় ক্ষত্র-বীর মানসিংহের আপন জামাতা?
দুর্জয়সিংহ : আশ্চর্যই বটে !
মানসিংহ : মানুষ হয়ে জন্মেছিল, একদিন তো সে মরতই—না-হয় দুদিন আগে মরেছে। কিন্তু রাজপুতনার মরুসিংহ মারা গেল বাংলার বকরির হাতে—এ দুঃখ রাখবার স্থান কোথায়, দুর্জয়সিংহ?
দুর্জয়সিংহ : মহারাজ, এ দুঃখ করতে পারেন।
মানসিংহ : জামাতা নিহত হয়েছে, কিন্তু তারও চেয়ে বড়ো দুঃখ যে, এই কাহিনি শুনে রাজপুতনার
নারীরা হাসবে, শত্রুরা উপহাস করে রটনা করবে, আমি নিজে ভয় পেয়ে ঈসা খাঁর সামনে
আমার জামাতাকে পাঠিয়েছিলাম । অনেকে ভাববে, আমরা কাপুরুষ ।
দুর্জয়সিংহ : এ বিধাতার বিধান, মহারাজ, সয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
মানসিংহ : না। আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করব—আমি ঈসা খাঁকে হত্যা করব ।
দুর্জয়সিংহ : কিন্তু সে কী করে সম্ভব হবে?
মানসিংহ : ঈসা খাঁ আমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল, পাঠিয়েছিলাম আমার জামাতাকে । আমার জামাতাকে হত্যা করে ভেবেছে, সে বুঝি মানসিংহকেই হত্যা করেছে । আমি তাকে জানিয়েছি, ঈসা খাঁর মুণ্ডপাত করার জন্য মানসিংহ এখনও জীবিত রয়েছেন । এবার দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান গিয়েছে আমার তরফ থেকেই
দুর্জয়সিংহ : কোনো উত্তর পেয়েছেন?
মানসিংহ : না, তবে এক্ষুনি পাব। জানি না; সে কাপুরুষ পুনরায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজি হবে কিনা ।
দূত : (প্রবেশান্তে কুর্নিশ করিয়া) মহারাজের জয় হোক
মানসিংহ : কি সংবাদ, দূত?
দূত : সংবাদ শুভ। মহারাজকে হত্যা করেছে ভেবে তারা উৎসব করছিল; এমন সময় আপনার আহ্বান নিয়ে আমি হাজির! তবে ঈসা খাঁ এ আহ্বান গ্রহণ করেছেন।
মানসিংহ : গ্রহণ করেছেন? অনেকক্ষণ পরে নিশ্চয়ই?
দূত : না মহারাজ! তক্ষুনি গ্রহণ করেছেন ।
মানসিংহ : তক্ষুনি? আচ্ছা, তা বেশ। কোনো জবাব এনেছ ?
দূত : এনেছি, মহারাজ! তবে দেখাতে সাহস হয় না ।
মানসিংহ : তোমাকে অভয় দিচ্ছি, দূত।
দূত : মহারাজ, ঈসা খাঁ লোকটা, নিতান্ত... নিতান্ত... এই নিতান্ত...
মানসিংহ : নিতান্ত কী?
দূত : আজ্ঞে, নিতান্ত গোঁয়ার। কারণ মহারাজের আহ্বানপত্র পেয়েই অমনি তলোয়ার খুললেন, তারপর নিজের হাত কেটে তারই রক্তে তলোয়ারের ডগা দিয়ে উত্তর লিখলেন—‘বহুত আচ্ছা'।
২
স্থান : লড়াইয়ের ময়দান। একদিকে পাঠান শিবির, অন্যদিকে মোগল শিবির। অদূরে এগারোসিন্ধুর কেল্লা—ময়দানের মাঝখানে ঈসা খাঁ ও মানসিংহ সামনাসামনি দাঁড়িয়ে।]
ঈসা খাঁ : নমস্কার, মহারাজ।
মানসিংহ : আদাব, খাঁ সাহেব ।
ঈসা খাঁ : এত তকলিফ করে এখানে না-এসে মহারাজ যদি আদেশ করতেন, তবে দিল্লিতে গিয়েই মহারাজের সঙ্গে আমি একহাত লড়ে আসতাম ।
মানসিংহ : বাংলার ঝোপে-জঙ্গলে আপনারা কেমন আছেন, একটু দেখতে শখ হলো, খাঁ সাহেব ।
ঈসা খাঁ : রাজপুতনার মরু-পর্বতের কোন অন্ধকার গুহায় মহারাজ কীরূপে থাকেন, তা দেখবার কৌতূহলও তো এ বান্দার হতে পারত !
মানসিংহ : পাঠানেরা দেখছি ইদানীং কথা বলতে শিখেছে।
ঈসা খাঁ : এ আপনাদের মতো কথা-সর্বস্বদের সঙ্গে থাকার ফল। আগে পাঠানেরা কথা বলত না; কথা বলত কেবল তাদের তির আর তলোয়ার ।
মানসিংহ : ইদানীং বুঝি তাহলে পাঠানদের তির-তলোয়ার ভোঁতা হয়ে পড়েছে!
ঈসা খাঁ : শাহি ফৌজের ওপর ক্রমাগত ব্যবহারে একটু ভোঁতা হয়েছে বৈকি !
মানসিংহ : তাহলে এখন তলোয়ার ছেড়ে কাবুলি মেওয়ার কারবার শুরু করলে হয় না, খাঁ সাহেব?
ঈসা খাঁ : কিন্তু কাবুলি মেওয়া এখানে খাবে কে? মহারাজের তো বাজরার খিচুড়ি আর ঘাসের রুটি খেয়ে খেয়ে পেট এমনি হয়েছে যে, কাবুলি আঙুরের গন্ধেই বমি আসে।
মানসিংহ : কিন্তু খাঁ সাহেব কি কেবল কথার যুদ্ধের জন্যই তৈয়ার হয়ে এসেছেন, না আরও কোনো মতলব আছে?
ঈসা খাঁ : সে সম্পূর্ণ মহারাজের অভিরুচি। ঈসা খাঁ যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থানে যে কোনো অস্ত্রে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত।
মানসিংহ : মনে হচ্ছে, শাহবাজ খাঁকে পরাজিত করে ঈসা খাঁর অহংকার বেড়েছে। কিন্তু ঈসা খাঁ কেবল ঘুঘু দেখেছেন, ফাঁদ দেখেন নাই ।
ঈসা খাঁ : কিন্তু ফাঁদের সঙ্গে যে এ বান্দার কিঞ্চিৎ পরিচয় ঘটেছে—এই মাত্র সেদিন-সে তো মহারাজের অজানা থাকবার কথা নয় ৷
মানসিংহ : সে কথা জানি, কাপুরুষ। আমার জামাতা—এক অনভিজ্ঞ তরুণ যুবক—বাগে পেয়ে তাকে তুমি হত্যা করেছ।
ঈসা খাঁ : খবরদার মানসিংহ। ঈসা খাঁকে 'কাপুরুষ' বলে কেউ কোনোদিন রেহাই পায় নাই । আর ঈসা খাঁ নিজে পর্দার আড়ালে থেকে জামাতাকে কখনও লড়াইয়ে পাঠায় নাই । কিন্তু আজ তোমাকে ক্ষমা করছি—সেই মহান যুবকের নামে, যিনি বীরের মতো যুদ্ধ করে সমর শয্যা গ্রহণ করেছেন ।
মানসিংহ : ভূতের মুখে রাম নাম! কিন্তু আত্মরক্ষা করো, ঈসা খাঁ ।
ঈসা খাঁ : তুমিও আত্মরক্ষা করো মানসিংহ ।
[যুদ্ধ শুরু হইল : লড়িতে লড়িতে ঈসা খাঁর তলোয়ারের আঘাতে মানসিংহের তলোয়ার ভাঙিয়া পড়িয়া গেল—নিরস্ত্র মানসিংহ ভীতভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন ।]
ঈসা খাঁ : এখন মহারাজকে রক্ষা করবে কে?
মানসিংহ : কেউ না; তুমি আমাকে হত্যা করো, ঈসা খাঁ।
ঈসা খাঁ : না, মহারাজ, সে হয় না। নিরস্ত্রের ওপর ঈসা খাঁ ওয়ার করে না।
মানসিংহ : তবে আমাকে বন্দি করো, আমি তোমার অনুগ্রহ চাই না ।
ঈসা খাঁ : তাও হয় না মহারাজ । আপনার মতো সাহসী যোদ্ধাকে বাগে পেয়ে আমি বন্দি করব না । এই নিন আমার তলোয়ার-যুদ্ধ করুন।
[নিজ তলোয়ার মানসিংহের হাতে তুলিয়া দিয়া বাম কটি হইতে অন্য তলোয়ার খুলিয়া দাঁড়াইলেন ।]
মানসিংহ : [একটু ভাবিয়া তলোয়ার ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন] আমি লড়ব না ।
ঈসা খাঁ : কেন, মহারাজ ?
মানসিংহ : আপনার সঙ্গে আমার যুদ্ধ নাই ।
ঈসা খাঁ : বটে।
মানসিংহ : ঈসা খাঁ, চমৎকার। দূর হতে তোমার কত নিন্দাই শুনেছি, ভাই কাছে এসেও এতদিন তোমাকে চিনতে পারি নাই। আজ তোমার সঙ্গে সত্যিকার পরিচয় হলো, এই-ই আমার পরম লাভ! তোমাকে চিনবার আগে মরলে মানসিংহের জীবনে একটা মস্ত ফাঁক থেকে যেত ।
ঈসা খাঁ : মহারাজ—ভাই—তোমার হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে আমিও ধন্য ।
মানসিংহ : তবে, এসো ভাই ! [আলিঙ্গন] আমাদের এই আলিঙ্গনের ভিতর দিয়ে মোগল-পাঠানের বন্ধুত্ব হোক, ভারতের হিন্দু- মুসলমানের মিলন হোক আর কখনো আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির পবিত্র বক্ষ কলঙ্কিত করব না ।
ইব্রাহীম খাঁ-র জন্ম ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে, টাঙ্গাইলের এক কৃষক পরিবারে। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। সারা বাংলায় তিনি প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ নামে পরিচিত। অসাধারণ অনেক ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ-কাহিনি ও শিশুসাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 'কামাল পাশা', ‘আনোয়ার পাশা' প্রভৃতি নাটক; ‘আলু বোখরা', ‘দাদুর আসর' গল্পগ্রন্থ; ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র' ভ্রমণ-কাহিনি। বাংলা নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান । ইব্রাহীম খাঁ ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।
ইব্রাহীম খাঁ এই নাট্যাংশে হাজির করেছেন ঈসা খাঁ ও রাজপুত বীর মানসিংহের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও মহানুভবতার কাহিনি। বাংলার পাঠান বীর ঈসা খাঁ দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিহত করেন মানসিংহের বীর জামাতাকে। প্রতিশোধ নিতে মানসিংহ এগারোসিন্ধু ময়দানে ঈসা খাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। ঈসা খাঁ বীরত্বের সঙ্গে তা গ্রহণও করেন। যুদ্ধ চলাকালে হঠাৎ মানসিংহের তলোয়ার ভেঙে গেলে তিনি ভীত হয়ে পড়েন। কিন্তু ঈসা খাঁ নিরস্ত্র মানসিংহকে আঘাত না করে তাঁর হাতে অপর একটি তলোয়ার তুলে দেন। ঈসা খাঁর বীরত্ব ও ঔদার্যে মানসিংহ বিস্মিত হয়ে তলোয়ার ছুড়ে ফেলে জানান, ঈসা খাঁর সঙ্গে তাঁর কোনো যুদ্ধ নেই । তারপর দুই বীর পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন। দুজনেই ভারতের মোগল-পাঠান আর হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব ও মিলনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। নাট্যাংশটিতে মোগল-ভারত আমলের বীরত্ব, মহানুভবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় ফুটে উঠেছে। প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের উদারতা ও মহানুভবতা।
এগারোসিন্ধু — কিশোরগঞ্জের একটি নদী।
মানসিংহ — রাজপুত বীর।
ঈসা খাঁ — পাঠান বীর । বাংলার বারো ভূঁইয়াদের একজন ।
দুর্জয়সিংহ — মানসিংহের সহচর।
অসুররাজ — অসুরদের রাজা ।
গোষ্পদ — গরুর খুরের চাপে তৈরি গর্ত ।
ক্ষত্র-বীর — ক্ষত্রিয় বীর।
বকরি — ছাগল
মেওয়া — ফল বিশেষ।
বাজরা — শস্য বিশেষ ।
রাজপুতনা — ভারতের রাজস্থানের অপর নাম ।
কুর্নিশ — মাথা নতকরা।
আহ্বানপত্র — দাওয়াত লিপি ।
ডগা –ভঅগ্রভাগ ।
বহুত আচ্ছা — খুব ভালো ।
তকলিফ — কষ্ট ।
কথাসর্বস্ব — কথাই সার যেখানে
ফাঁদ — কৌশল, ছল। পশুপাখি ধরার যন্ত্রবিশেষ।
ওয়ার — আঘাত ।
অনুগ্রহ — দয়া ।
আরও দেখুন...